১৫ আগস্ট কী বেগম জিয়ার জন্মদিন ?
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ আগস্ট ২০২০, ৯:৪২:০১ অপরাহ্ন
মোঃ আব্দল মালিক : ১৫ আগস্ট কী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন? অবশ্যই না। তবে কেন তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন পালন শুরু করলেন ? এই নিবন্ধ পাঠে তা জানা যাবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখনই এক হীন মতলবে শোক দিবসের পাল্টা হিসেবে ১৫ই আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের সূত্রপাত।
প্রত্যেক মানুষের একটি মাত্র জন্মদিন থাকে। ঘটা করে অনেকে তা পালনও করে থাকেন। আর সেলিব্রেটির জন্মদিন হলে তো কথাই নেই। তারা জন্মদিন পালন না করলেও ভক্ত, সমর্থক, অনুসারীরা তা পালন করে থাকেন। বেগম খালেদা জিয়া তার দলের নিকট একজন সেলিব্রেটি। ১৫ আগস্ট কারো জন্ম হলে সে কী তার জন্ম দিন পালন করবে না? অবশ্যই করবে। ১৫ আগস্ট বেগম জিয়ার প্রকৃত জন্মদিন নয়। এটা তার বানানো জন্মদিন। এই জন্মদিনের শুরু ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর। উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ঘোষিত জাতীয় শোক দিবসকে তুচ্ছ তাচিছল্য, কটাক্ষ ও খাটো করা। ১৫ আগস্ট যদি কোন বাঙালির জন্মদিন হয় তবুও জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্মদিন অনানুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করবেন বা আনন্দ উৎসব থেকে বিরত থাকবেন এঁটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বেগম জিয়া এবং তার দল করলেন তার উল্টো।
বেগম খালেদা জিয়ার আসল জন্মদিন যা তার পরিবার, শিক্ষা সনদ, বিয়ের কাবিন এবং ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরকারী সূত্রে গণ মাধ্যমের রেকর্ডে নথিভুক্ত আছে। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর থেকেই বিএনপিতে রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দেয়। বিএনপির রাজনৈতিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে আনা হয়। গৃহবধু থেকে বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী হওয়ার পর বেগম জিয়ার সাফল্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন তারই পিতা ইসকান্দার মজুমদার। তিনি এবং তার স্ত্রী তৈয়বা খাতুন তাদের তৃতীয় মেয়ে খালেদা খানম পুতুলের জন্ম, শিক্ষা, বিয়ে, বংশ পরিচয় ও পারিবারিক পরিচয় তুলে ধরেছিলেন ১৯৮৪ সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। উক্ত সাক্ষাতকারের এক অংশে পিতা ইসকান্দার বলেছিলেন, “আমার তৃতীয় মেয়ে হচ্ছে খালেদা।
খালেদার জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর একটি ঐতিহাসিক দিনে, যে দিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে বিশ্বের বুকে শান্তি এলো। আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছিলেন ডা. অবনী গোস্বামী। তিনি বলেছিলেন আপনার এই মেয়ে অত্যন্ত ভাগ্যবতী হবে। তার নাম আপনারা ‘শান্তি’ রাখুন। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারনে সেটা তখন সম্ভব ছিল না। তাই তার ডাক নাম রাখলাম ‘পুতুল’। খালেদা জিয়া সবারই আদরের এবং দেখতে শুনতেও সবার চেয়ে ভালো ছিল। সেজন্য আমরা ‘পুতুল’ বলেই ডাকতাম। আজো সেই নামেই আমরা ডাকি। তার পুরো নাম ছিল ‘খালেদা খানম’। ১৯৬১ সালে খালেদার সাথে জিয়াউর রহমানের বিয়ে হয়। তখন জিয়া ছিল ক্যাপ্টেন। ডি,জি,এফ, আইয়ের অফিসার হিসেবে তার পোস্টিং ছিল দিনাজপুর। জিয়া ছিল আমার স্ত্রীর ভাগ্নে। তার চাচাত বোনের ছেলে। খালেদা সেবার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র।
বিয়ের কয়েক দিন আগে জিয়া আমাদের বাসায় এসে একদিন হঠাৎ করে বলে বসলো আপনারা আগামী শুক্রবারের মধ্যে যদি বিয়ে দেন তাহলে বিয়ে হবে, নইলে আর বিয়েই করব না। আমরা বললাম বেশ তাই হবে। বিয়ে হয়ে গেল দিনাজপুরের মুদি পাড়ায়। বিয়েতে জিয়ার মামা, নানা ও বিভাগীয় অনেক বন্ধু-বান্ধব উপস্থিত ছিলেন। আমাদের বিয়ে হয়েছে ১৯৩৭ সালের ২৯ মার্চ। আমার স্ত্রীর জন্ম ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে। নাম তৈয়বা খাতুন। তার বাপের বাড়ি দিনাজপুরের (বর্তমান পঞ্চগড়ের) চন্দন বাড়িতে। তারা মীর জুমলার বংশধর। বাংলাদেশী টি ফ্যামিলী নামে খ্যাত। এই ফ্যামিলি বক্সার যুদ্ধে বৃটিশ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পরে বৃটিশ সরকার তাদেরকে তামার পাতে লেখা সনদ উপহার দেয়। তারা বিনা খরচে ইংল্যান্ড যেতে পারতো। যার ফলে এদের ভিতরে অনেকেই মেম বিয়ে করে বিলেতবাসী হয়ে গেছেন। আমার শ্বশুড় ছিলেন জেলা সাব রেজিষ্ট্রার।
আমার স্ত্রীর কোন ভাই নেই। তারা দু’বোন।” ঐ সাক্ষাতকারের আরেক অংশে বেগম খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা খাতুন তার মেয়ে সম্পর্কে বলেছিলেন, “ খালেদা খুব বেশি লেখাপড়া করত না, তবে লেখাপড়ায় ভাল ছিল। নাচ শিখেছে ওস্তাদের কাছে। অনেক ফাংশনে নেচে পুরস্কার পেয়েছে। গান শুনতে ভালবাসতো। কথা খুব বেশি বলতো না। লেখাপড়া করেছে প্রথমে মিশনারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ও পরে দিনাজপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।” বেগম জিয়ার মা-বাবা প্রদত্ত সাক্ষাতকার অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সাল। ১৯৬১ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর লেখাপড়া করেছিলেন বলে তার মা- বাবা উল্লেখ করেন নাই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের রেকর্ডে দেখা যায় বেগম জিয়া ১৯৫৪ সালের ১লা জানুয়ারি দিনাজপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ভর্তি রেজিষ্টার অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সাল। তিনি ঐ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বোর্ডের রেকর্ডে দেখা যায় তার নাম খালেদা খানম, পিতা মোহাম্মদ এসকান্দর।
অত্র বোর্ডের আওতাধীন দিনাজপুর কেন্দ্রের দিনাজপুর বালিকা বিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৬১ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। তার রোল নম্বর ছিল ‘রোল-দিনা নং এফ-৭৯২’। ফলাফলে দেখা যায় তিনি ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল ও ঐচ্ছিক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন। বিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের রেকর্ড থেকে দেখা যায় তার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সাল। পরবর্তীকালে তিনি আর মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে কোন রেকর্ড ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে নেই। মা বাবার বক্তব্য অনুযায়ী বেগম জিয়ার জন্ম সাল এবং বিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ডের রেকর্ডের জন্ম সালের মধ্যে এক বৎসরের পার্থক্য দেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে বয়স কমানো। তাই জন্ম তারিখ ঠিক রেখে জন্ম সাল এক বৎসর কমিয়ে দেওয়া হয়। আগে সার্টিফিকেটে বয়স কমানোর একটা প্রবণতা ছিল।
বেগম জিয়ার কাবিনে দেখা যায় তার জন্ম তারিখ ৫ আগস্ট ১৯৪৪ সাল। বেগম জিয়ার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সাল বা ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সাল অনুযায়ী বিয়ের সময় তার বয়স দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৪ অথবা ১৫ বছর। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য এটা আইনসিদ্ধ নয়। তাই আইনসিদ্ধ করার জন্য জন্ম তারিখ এমনভাবে পিছানো হয় যাতে ১৬ বৎসর হয়। এখানে কাবিনের প্রয়োজনে জন্ম সাল ও মাস পরিবর্তন করা হলেও তারিখ ৫ ঠিক রাখা হয়।
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে মনোনয়ন ফরমে এবং নির্বচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিভিন্ন পত্রিকায় এবং রেডিও ও টেলিভিশনে সরকারী ভাবে পাঠানো তার জীবন বৃত্তান্তে তার জন্ম দিন ১৯ আগস্ট ১৯৪৫ উল্লেখ করা হয়, যা ঐ সময়কার পত্র-পত্রিকায় লিড নিউজ আকারে ছাপা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া সফরকালে সরকারীভাবে ছাপানো প্রধানমন্ত্রীর জীবন বৃত্তান্তে এবং তার কূটনৈতিক পাসপোর্টে জন্ম তারিখ উল্লেখ আছে ৫ সেপ্টেম্বের ১৯৪৬ সাল। তাছাড়া অন্যান্য আরো অনেক সরকারী রেকর্ড পত্রে তার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বের উল্লেখ আছে। ২০১৫ সালে তার ছেলে তারেক রহমানকে দেখতে লন্ডনে যাওয়ার সময় তিনি যে ডিজিটাল পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন তাতে তার জন্ম তারিখ ৫ আগস্ট উল্লেখ আছে।
ফখরউদ্দিন মঈনউদ্দিন সরকারের সময় প্রণীত জাতীয় পরিচয় পত্রে দেখা যায় বেগম জিয়ার জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল। এই সন তারিখ যে একেবারে সঠিক নয় তার প্রমাণ তার শিক্ষা সনদ, বিয়ের কাবিন ও সরকারী অন্যান্য তথ্য বিবরণী। শিক্ষা সনদ অনুযায়ী তিনি ১৯৬১ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন এবং বিয়েও হয় সেই ১৯৬১ সালে। শিক্ষা বোর্ডের নিয়মানুযায়ী একজন শিক্ষার্থী সাধারণভাবে ১৬ বৎসর বয়সে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে।
বিশেষ কারণে এক দুই বৎসর বেশ কম হতে পারে। তবে ১৪ বৎসরের কম বয়সে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায় না। আবার ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ের কনের বয়স কমপক্ষে ১৬ বৎসর পূর্ণ হতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বেগম জিয়ার জন্ম হলে ১৯৬১ সালে তার বয়স দাঁড়ায় মাত্র সাড়ে ১৩ বৎসর। এই বয়সে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বা বিয়ের কাবিন রেজিষ্ট্রি করা মোটেও সম্ভব নয়।
বেগম জিয়ার এতগুলো জন্ম তারিখ ও সাল পর্যালোচনা করে দেখা যায় তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় জন্ম সাল বদলিয়েছেন বয়স কমানোর জন্য, বিয়ের কাবিনে জন্ম সাল এবং মাস বদলিয়েছেন বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রি আইন সিদ্ধ করার জন্য। জাতীয় পরিচয় পত্রে জন্ম সাল এবং তারিখ বদলিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে ঘোষিত জাতীয় শোক দিবসকে স্লান করার জন্য। শোকের দিনে তথাকথিত জন্ম দিনে কেক কেটে আনন্দ উল্লাস, হৈ হুল্লা করার জন্য।
যে মহান নেতার আত্মত্যাগ ও আজীবন সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যার বদৌলতে অনেকের মত একজন গৃহবধু ও একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে, বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসেছেন। যে মহান নেতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সে দিন যে গৃহবধুর সংসার টিকে ছিল, আজ সেই গৃহবধু সেই মহান নেতার মৃত্যু দিবসকে স্লান করার জন্য নিজের ভূয়া জন্মদিন পালন করছেন!!!!!
সত্যিই সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ, তার চেয়ে বিচিত্র এই দেশের মানুষ।
লেখক : মোঃ আব্দল মালিক
সমন্বয়কারী-বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সিলেট জেলা শাখা।
সহ-সভাপতি- বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, সিলেট জেলা শাখা।
- 9Shares