বিশ্বকাপের বিষাদ আর ভারতীয় ক্রিকেটের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত: মুদ্রার দুই পিঠ

খেলা

মেলবোর্ন থেকে বেঙ্গালুরু, কার্ডিফ হয়ে অ্যাডিলেইড—মানচিত্রের এই বিন্দুগুলো বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য কেবলই এক একটা দীর্ঘশ্বাসের নাম। বিশ্বমঞ্চে ভারতের বিপক্ষে লড়াই মানেই যেন টাইগারদের জন্য এক অবধারিত আক্ষেপের গল্প। অ্যাডিলেইড ওভালের সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটুকুও ঢাকতে পারেনি সেই পুরনো যন্ত্রণার ছাপ। “২০১৬ বিশ্বকাপের মতোই আমরা খুব কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু তা যথেষ্ট হয়নি”—সাকিবের এই উক্তিতেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে, ভারতের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছে গিয়েও তরী ডোবানোর বেদনাটা কতটা গভীর।

বেঙ্গালুরুর সেই দুঃসহ স্মৃতি ও আক্ষেপের পুনরাবৃত্তি

সাকিবের কথায় ফিরে আসে সাড়ে ছয় বছর আগের বেঙ্গালুরুর সেই অভিশপ্ত রাতের কথা। মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো অভিজ্ঞ সেনানী ক্রিজে থাকার পরও শেষ তিন বলে মাত্র দুই রান নিতে না পারার সেই স্মৃতি আজও যে কাউকে শিউরে তোলে। গ্যালারিতে থাকা গুটিকয় বাংলাদেশি সমর্থক যখন আগাম জয়ের উল্লাসে মেতেছিলেন, ঠিক তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে স্তব্ধ হয়ে যায় সব। সেই ম্যাচটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে।

শুধু ২০১৬ নয়, ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ১০৯ রানের হারের সেই বিতর্কিত ম্যাচ কিংবা ২০১৯ বিশ্বকাপে কার্ডিফের স্মৃতি—সবই যেন একই সুতোয় গাঁথা। ২০১৯ সালে রোহিত শর্মার ৯ রানে দেওয়া সহজ ক্যাচটি তামিম ইকবাল লুফে নিতে পারলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। কিন্তু সেই রোহিতই শেষ পর্যন্ত ১০৪ রানের ইনিংস খেলে ভারতের বড় স্কোরের ভিত গড়ে দেন। ছোট ছোট ভুল আর বড় আক্ষেপের এই বৃত্ত থেকে আজও বের হতে পারেনি বাংলাদেশ।

অ্যাডিলেইডে লিটনের বীরত্ব ও প্রকৃতির চোখ রাঙানি

আক্ষেপের সর্বশেষ সংযোজন ছিল অ্যাডিলেইড। ১৮৫ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে লিটন দাস যেভাবে ব্যাট হাতে পাল্টা আঘাত হানলেন, তা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের স্মৃতিবিজড়িত মাঠে ভারতীয় বোলারদের সাধারণ মানের বানিয়ে লিটন যে দাপট দেখালেন, তাতে জয়ের স্বপ্নটা উজ্জ্বল হয়েই ধরা দিয়েছিল। কিন্তু বেরসিক বৃষ্টি আর প্রকৃতির খেলায় আবারও সেই পুরনো হতাশা। কাছে গিয়েও ছোঁয়া হলো না কাঙ্ক্ষিত জয়। তবে বাংলাদেশের এই মাঠের লড়াইয়ের আড়ালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অন্দরমহলে চলছে আরেক নাটকীয়তা, যা তাদের নিজেদের জন্যই ‘আত্মঘাতী’ হয়ে উঠছে।

ভারতীয় ক্রিকেটের হঠকারী সিদ্ধান্ত ও বিশৃঙ্খলা

বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পেলেও ভারতীয় ক্রিকেটের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষ করে লখনউতে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পণ্ড হওয়ার ঘটনা এবং সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত তাদের বোর্ডের অপেশাদারিত্বকেই সামনে এনেছে। শুবমান গিলকে অপরিপক্ব অবস্থায় নেতৃত্বের ভার দেওয়াটা ছিল এমনই এক হঠকারী সিদ্ধান্ত। টেস্ট দলের অধিনায়কত্বের চাপ সামলাতে না সামলাতেই টি-টোয়েন্টির সহ-অধিনায়কত্ব—সব মিলিয়ে তরুণ এই ব্যাটারের ফর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

একইসাথে ঘরের মাঠে পিচ নিয়ে অতিরিক্ত কারসাজি করতে গিয়েও বিপাকে পড়েছে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে স্পিন সহায়ক উইকেট বানিয়ে উল্টো প্রতিপক্ষ স্পিনার সাইমন হারমারের ঘূর্ণিজাদুতে কুপোকাত হতে হয়েছে স্বাগতিকদের। যেখানে ভারতীয় ব্যাটাররাই এখন আর স্পিনটা আগের মতো ভালো খেলেন না, সেখানে এমন সিদ্ধান্ত ছিল পায়ে কুড়াল মারার শামিল।

কোচিং ও দল নির্বাচনে অস্থিরতা

গৌতম গম্ভীরের কোচিংয়ে ভারতীয় দলে চলছে এক অদ্ভুত ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলা। প্রতিনিয়ত দল ও পজিশন পরিবর্তন করার ফলে সাই সুদর্শন, নিতিশ কুমার রেড্ডি কিংবা সাঞ্জু স্যামসনের মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার এখন হুমকির মুখে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বদলে ক্ষণস্থায়ী পরীক্ষানিরীক্ষাই যেন এখন মূল মন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে বিসিসিআই-এর অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত নজির দেখা গেল লখনউ টি-টোয়েন্টিতে। শীতের এই সময়ে উত্তর ভারতে কুয়াশা থাকাটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। অথচ সেই বাস্তবতা উপেক্ষা করে লখনউতে ম্যাচ আয়োজন করা হলো। যার ফলে যা হওয়ার তাই হলো—কুয়াশার চাদরে ঢাকা মাঠে খেলা তো দূরের কথা, বল দেখাই দায় হয়ে পড়ল। আম্পায়াররা একাধিকবার মাঠ পরিদর্শন করে রাত ৯টা ২৫ মিনিটে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন।

দায়বদ্ধতাহীনতার সংস্কৃতি

বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড হওয়ার পরও ভারতের ভেন্যু নির্বাচন ও সূচি প্রণয়নে এমন অদূরদর্শিতা সত্যিই বিস্ময়কর। দীপাবলির ঠিক পরেই যখন দিল্লির বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তখন সেখানে টেস্ট ম্যাচ ফেলা কিংবা প্রচণ্ড কুয়াশার মধ্যে লখনউতে খেলা আয়োজন—এসব সিদ্ধান্তে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়ই ফুটে ওঠে। ক্রিকেটারদের যেন দাবার ঘুঁটি বানিয়ে ফেলা হয়েছে, যাদের ভালোমন্দের চেয়ে বোর্ডের খেয়ালখুশিই বেশি গুরুত্ব পায়। এই অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাব ভারতীয় ক্রিকেটের পেশাদারিত্বকে বড়সড় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মাঠের ক্রিকেটে তারা হয়তো জিতছে, কিন্তু প্রশাসনিক অদক্ষতায় তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।